যাকাত না দেয়ার ফলে বৈষয়িকভাবে সমাজে যেসব বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে তাতো দিবাকরের ন্যায় সুষ্পষ্ট। যেমন ধনীদের সম্পদে গরীবের নির্ধারিত যে হক্ব রয়েছে তা প্রতিষ্ঠিত হয় না। ফলে সম্পদ একটা বিশেষ শ্রেণীর হাতেই কুক্ষিগত হয়ে যায় এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি থাকে না বিধায় একটি নিয়ন্ত্রণহীন অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যাতে করে একদিকে ধনাঢ্য সবল শ্রেণীর লোকেরা দরিদ্র-দুর্বল শ্রেণীর মানুষের প্রতি স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। অন্যদিকে গরীব জনগোষ্ঠি দারিদ্রের নিষ্পেষণে অতীষ্ঠ হয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং চুরি-ডাকাতি রাহাজানি, ছিনতাই, খুন-খারাবীসহ অবর্ণনীয় চারিত্রিক পদস্খলনের শিকার হয়ে নানা ধরনের পাপাচারের দিকে ধাবিত হয়। এভাবে গোটা সমাজটা এক চর্তুমুখী অন্যায় ও অনাচারের আখড়ায় পরিণত হয়ে ধ্বংসের মুখে পতিত হয়।
এছাড়াও পবিত্র ক্বোরআন ও হাদীসে যাকাত না দেয়ার ফলে ইহকালীন ও পরকালীন যে সব অকল্যাণ ও দুর্বিসহ য্ন্ত্রণার সুবিস্তৃত বর্ণনা এসেছে এর কিঞ্চিত তুলে ধরা হচ্ছে-
১. যাকাত না দেয়ার ফলে আল্লাহ তা’আলা অসন্তুষ্ঠ হন এবং পরকালে তার ঠিকানা হবে জাহান্নামে। এরশাদ হচ্ছে-
اَلَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَيُنْفِقُوْنَهَا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْ هُمْ بَعَذَابٍ اَلِيْمٍ
তরজমাঃ যারা (যাকাত ও ওয়াজিব সাদাক্বাদি আল্লাহর রাস্তায় পরিশোধ না করে অবৈধভাবে) স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চিত করে রাখে তাদেরকে বেদনাদায়ক শাস্তির সুসংসবাদ শুনিয়ে দিন। [সূরা তাওবা আয়াত-৩৪]
এ বেদনাদায়ক শাস্তির বর্ণনা সত্যিই ভয়ঙ্কর! নিম্নোল্লিখিত আয়াত এবং হাদীসগুলো গভীর মনযোগ দিয়ে পড়ুন-
يَوْمَ يُحْمى عَلَيْهَا فِى نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَظُهُوْرُهُمْ – هذَا مَاكَنَزْتُمْ لِاَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَاكُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ
তরজমাঃ যেদিন তা উত্তপ্ত করা হবে জাহান্নামের আগুনে অতঃপর তা দ্বারা দাগ দেওয়া হবে তাদের ললাটগুলোতে এবং পার্শ্ব ও পৃষ্ঠদেশগুলোতে (বলা হবে) এটা হচ্ছে তাই যা তোমরা নিজেদের জন্যে পুঞ্জীভুত করে রেখেছিলে। এখন এ পুঞ্জীভূত করার স্বাদ গ্রহন করো। [সূরা তাওবা, আয়াত-৩৫]
সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী প্রখ্যাত সাহাবী সাইয়েদুনা হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়তম রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা যাকে ধনসম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে তার যাকাত আদায় করে নি; ক্বিয়ামত দিবসে তার সম্পদকে এমন এক বিষধর সাপে রূপান্তর করা হবে, যা অত্যধিক বিষাক্ত হওয়ার কারণে তার মাথার পশম থাকবেনা এবং চোখের উপর দুটি কালো তিলক থাকবে।
ক্বেয়ামতের দিন ওই সাপ তার গলায় হারের ন্যায় পরিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের উভয় চোয়ালে কামড় দিয়ে ধরবে এবং বলবে, আমিই তোমার ধনসম্পদ ‘আমিই তোমার সঞ্চিত ধন ভান্ডার’। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সমর্থনে পবিত্র ক্বোরআনের এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন-
وَلَايَحْسَبَنَّ الَّذِيْنَ يَبْخَلُوْنَ بِمَآ اتهُمْ اللهُ مِنْ فَضْلِه هُوَ خيرٌ لَّهُمْ- بَلْ هُوَ شَرُّلَّهُمْ سَيُطَوَّقُوْنَ مَ بَخِلُوْ ابِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- وَلِلهِ مِيْرَاثُ السَّموَاتِ وَالْاَرْضِ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرٌ
অর্থাৎ আর যারা কার্পণ্য করে (আল্লাহ ও বান্দার হক্ব নিয়ে) ওই জিনিসের মধ্যে, যা আল্লাহ তাদেরকে আপন করুণা থেকে (ধন সম্পদ বা জ্ঞানাকারে) দান করেছেন তারা কখনো যেন ওই কৃপণতাকে নিজেদের জন্য মঙ্গলজনক মনে না করে বরং সেটা তাদের জন্য অকল্যাণকর। তারা যে সব সম্পদের মধ্যে কার্পণ্য করেছিলো অচিরেই ক্বিয়ামতের দিন সেগুলো তাদের গলায় শৃঙ্খল হবে এবং আল্লাহ ত’আলাই নভোমন্ডল ও ভুমন্ডলের স্বত্ত্বাধিকার। আর আল্লাহ আমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবগত। [সূরা আল-ই ইমরান, আয়াত ১৮০]
হযরত ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম আলায়হিমার রাহমাহ মশহুর সাহাবী হযরত আবূ যার গিফারী রাদ্বিআল্লাহু তা’আলা আনহুর সূত্রে বর্ণনা করছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- যে কোন উট, গরু কিংবা ছাগল, ভেড়ার মালিকে নেসাব হওয়া সত্বেও যাকাত আদায় করবে না, ক্বিয়ামতের দিন এইগুলোকে পূর্বের চেয়েও অধিক বিরাট ও মোটা তাজা অবস্থায় উপস্থিত করা হবে। তারা ক্বিয়ামত দিবসের শেষ অবধি একের পর এক দলে দলে মালিককে পায়ের ক্ষুর দ্বারা দলিত-মথিত আর শিঙ্গের আঘাতে জর্জরিত করতে থাকবে।
২. সম্পদের যাকাত আদায় না করলে হারামে-হালালে মিশ্রণ ঘটে যায়। ফলে এ অবৈধ মালের মিশ্রণ বৈধ মালকেও ধ্বংস করে দেয়।
যেমন উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা বলেন- আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছি, তিনি প্রায়শ বলতেন, যাকাতের মাল যে সম্পদের সাথে মিশ্রিত হয় (সেটা ফরয যাকাত আদায় না করার কিংবা সামর্থ্যবান ব্যক্তি লোভের বশীভূত হয়ে অহেতুক যাকাত গ্রহণ করার মাধ্যমে) সেটা ওই সম্পদকে ধংস করে দেয়। অর্থাৎ হারামের মিশ্রণ হালালকেও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।
৩. সর্বপরি অস্বীকারবশতঃ স্বেচ্ছায় যাকাত না দেওয়া ক্বতলযোগ্য অপরাধ এবং কুফরীর শামিল। ইসলামের প্রথম খলীফা মানবকুলে আম্বিয়ায়ে কেরামের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সাইয়্যেদুনা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্বে আকবার রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু প্রিয়তম রাসূলের ওফাত শরীফের পর যখন সে খিলাফতের দায়িত্ব নিলেন তখন খাঁটি ও নির্ভেজাল মুমিনদের থেকে পৃথক হয়ে তিনটি দল স্বস্ব চরিত্রে আত্মপ্রকাশ করলো। এক দল সরাসরি ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে মুর্তাদ্দ হয়ে গেলো দ্বিতীয় দল মুর্তাদ্দ হল আসওয়াদ আনাসী মুসাইলামা কাযযাব প্রমুখ ভন্ডনবী হয়ে এবং তাদের অনুসারি হয়ে আর তৃতীয় দল মুর্তাদ্দ হল নিজেদেরকে মুসলমান পরিচয় দেয়ার আড়ালে ইসলামের একটি জরুরী বিষয় ‘যাকাত’ অস্বীকার করার মাধ্যমে। খলীফাতুর রাসূল এদের সকলের বিরুদ্ধে সফল জিহাদ করছেন; কিন্তু সবার আগে জিহাদ ঘোষনা করেছেন শোষোক অর্থাৎ যাকাত অস্বীকার কারীদের বিরুদ্ধে। যেহেতু এরা ছিলো ‘ঘরশক্র বিভীষণ’। তাই ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতকে মুক্ত ও সাবধান করা সত্যিই জরুরী ছিলো। প্রথম প্রথম বাহ্যিকভাবে যাঁরা খলীফার সাথে দ্বিমত পোষণ করেছিলেন তাঁরাও শেষ পর্যন্ত খলীফার অটল ও নির্ভুল সিদ্ধান্তের দিকে প্রত্যাবর্তন করেন এবং তাঁর প্রশংসা করেছেন। খলীফাতুর রাসূল ঘোষণা করলেন- বিশাল অংকের যাকাত নয় বরং একটি ছাগলের ছোট বাচ্চাও যদি যাকাতের হিসেবে আসে, আর তা পরিশোধ করতে কেউ অস্বীকার করে তাঁর বিরুদ্ধেও আমি জিহাদ ঘোষণা করলাম। কারণ, ‘যাকাত’ও ইসলামের হক্ব। ওই হক্ব কাইকেও ধ্বংস করতে দেয়া হবে না। -সুত্রঃ গাউসিয়া তারবিয়াতী নেসাব-